প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স না পাঠালে দেশের কি ক্ষতি হবে?

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশে প্রচুর সংখ্যক প্রবাসী তাদের কষ্টার্জিত অর্থ পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলছেন। কিন্তু যদি প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দেয়, তাহলে কী ঘটতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে রেমিট্যান্সের অভাব দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই ব্লগে আমরা রেমিট্যান্স না আসার ফলে দেশের অর্থনীতি, সরকার, পরিবার ও সমাজে কী ধরণের প্রভাব পড়তে পারে তা বিশদভাবে আলোচনা করবো।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর প্রভাব

রেমিট্যান্স দেশের জিডিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রবাসীরা যদি রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দেয়, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে। গ্রামীণ এবং শহুরে অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে অনেক সুযোগ তৈরি হয়। অনেক ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রেমিট্যান্সের অর্থ ব্যবহার করে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে। এই অর্থায়ন বন্ধ হলে, অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, যা অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

এছাড়া, রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গৃহীত অর্থ বিভিন্ন সামাজিক এবং অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়। এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স না পাঠালে, এসব প্রকল্প থেমে যাবে এবং উন্নয়নের গতি হ্রাস পাবে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে রেমিট্যান্সের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রবাসীরা রেমিট্যান্স না পাঠালে দেশের কি ক্ষতি হবে

বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ হ্রাস

রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় উৎস। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়। এটি দেশের আমদানি ও রপ্তানির ভারসাম্য রক্ষা করে। যদি এই রেমিট্যান্স বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেলে, দেশের মুদ্রার মান হ্রাস পাবে এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। এছাড়া, আমদানি খরচ বেড়ে যাবে, যা দেশের অর্থনীতিতে আরও চাপ সৃষ্টি করবে।

বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পাবে। এটি আমদানি-নির্ভর বিভিন্ন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যা কর্মসংস্থান এবং উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেলে দেশের আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা কমে যাবে, যা অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তুলবে।

রিজার্ভ আসলে কি, কেন রাখা হয়, কিভাবে রাখা হয়, রিজার্ভ কমে গেলে কি ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে নিচে দেওয়া বিবিসি বাংলার ভিডিও প্রতিবেদনটি দেখতে পারেন।

সৌজন্যেঃ বিবিসি বাংলা

পরিবার ও সমাজের উপর প্রভাব

রেমিট্যান্সের অর্থ প্রাপ্তি অনেক পরিবারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে। এই অর্থ দিয়ে পরিবারগুলি তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে পারে, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে খরচ করতে পারে। প্রবাসীরা যদি রেমিট্যান্স না পাঠায়, তাহলে এসব পরিবার আর্থিক কষ্টে পড়বে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান নেমে যাবে। অনেক পরিবার তাদের সন্তানের শিক্ষার খরচ, চিকিৎসা খরচ এবং অন্যান্য জরুরি চাহিদা মেটাতে রেমিট্যান্সের উপর নির্ভর করে। এই অর্থায়ন বন্ধ হলে এসব চাহিদা মেটানো কঠিন হবে এবং পরিবারগুলো মানসিক ও আর্থিক চাপের মধ্যে পড়বে।

সামাজিকভাবে, রেমিট্যান্স বন্ধ হলে গ্রামের অর্থনীতি বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক গ্রামের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড রেমিট্যান্সের অর্থের উপর নির্ভরশীল। এই অর্থায়ন বন্ধ হলে গ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, যা গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দেবে। সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে রেমিট্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কর্মসংস্থানের উপর প্রভাব

রেমিট্যান্সের মাধ্যমে অনেক ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। প্রবাসীরা রেমিট্যান্স না পাঠালে, এই উদ্যোগগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে। ফলে দেশের বেকারত্ব হার বাড়বে। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গঠিত উদ্যোগগুলো স্থায়ী এবং সাময়িক কর্মসংস্থান তৈরি করে। রেমিট্যান্স না আসলে এসব উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠবে।

কর্মসংস্থানের অভাবে দেশের যুব সমাজের মধ্যে হতাশা এবং অসন্তোষ বৃদ্ধি পাবে। এটি সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে এবং দেশের সার্বিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে রেমিট্যান্স অত্যন্ত জরুরি।

সরকারের উপর চাপ

রেমিট্যান্সের অভাবে সরকারের উপর বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। সরকারের রাজস্ব আয় কমে যেতে পারে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আসে, যা সরকারের রাজস্ব আয়ে অবদান রাখে। রেমিট্যান্স না এলে ব্যাংকিং খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং সরকারের রাজস্ব হ্রাস পাবে। এছাড়া, সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের উপর প্রভাব ফেলবে।

সরকারের বিভিন্ন আর্থিক নীতি এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে রেমিট্যান্সের অর্থের উপর নির্ভর করতে হয়। রেমিট্যান্স বন্ধ হলে, সরকারের আর্থিক সংকট বৃদ্ধি পাবে এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হবে। এছাড়াও সরকার রাজনৈতিকভাবেও চাপে পড়তে পারে। সরকারের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে রেমিট্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর সমস্যা

প্রবাসীরা যদি বৈধ পথে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে অবৈধ পথে (যেমন: হুন্ডি) রেমিট্যান্স পাঠায়, তবে দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানো হলে দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর প্রভাব পড়বে এবং সরকারের রাজস্ব আদায়ে ক্ষতি হবে। এছাড়া অবৈধ রেমিট্যান্সের মাধ্যমে কালো টাকা সৃষ্টির সম্ভাবনা বেড়ে যায়, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তোলে। অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যাবে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হ্রাস পাবে।

অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানো হলে, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে। ব্যাংকিং খাতের লেনদেন কমে যাবে এবং ব্যাংকগুলোর আয় হ্রাস পাবে। এটি দেশের আর্থিক বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিবেশকে দুর্বল করে তুলতে পারে। অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

কর আদায়ে সমস্যা

অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানো হলে সরকার কর আদায় করতে ব্যর্থ হবে। ফলে সরকারের আর্থিক সংকট বৃদ্ধি পাবে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করা কঠিন হবে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো হলে সরকারের রাজস্ব বাড়ে এবং এই অর্থ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে ব্যয় করা যায়। অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর ফলে এই রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়ে যাবে এবং সরকারের আর্থিক সংকট তৈরি হবে।

সরকারের কর আদায়ের পরিমাণ হ্রাস পেলে, দেশের বিভিন্ন সেবা এবং সুবিধা প্রদান কমে যাবে। সরকারি ব্যয় হ্রাস করতে হবে, যা দেশের উন্নয়ন প্রকল্প এবং জনসাধারণের সেবায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কর আদায়ে সরকারের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অবৈধ রেমিট্যান্সের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর প্রভাব

রেমিট্যান্সের অভাবে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিভিন্ন সেবা এবং সুবিধা প্রদান করতে ব্যর্থ হবে। এর ফলে, গ্রাহকদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটবে। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুবিধা প্রদান করে, তা বন্ধ হয়ে গেলে সাধারণ মানুষের আর্থিক ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে উঠবে। এটি ব্যক্তিগত আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং সার্বিক অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য রেমিট্যান্সের অবদান অপরিসীম। রেমিট্যান্স কমে গেলে ব্যাংকিং খাতের বিনিয়োগ কার্যক্রম হ্রাস পাবে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হবে না। এটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমিয়ে দেবে এবং সার্বিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করবে।

আন্তর্জাতিক পণ্য বা সেবা ক্রয় করার ক্ষেত্রে অসুবিধা

বিভিন্ন ধরণের পণ্য বা সেবা দেশের বাহিরের থেকে ক্রয় করতে হয়। রেমিট্যান্স কমে গেলে সেসব পণ্য বা সেবা ক্রয় করা খুবই অসুবিধাজনক হয়ে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, আপনারা যেই ওয়েবসাইটটিতে লেখাটি পড়ছেন সেটির ডোমেইন হোস্টিং তথা ওয়েবসাইটের নাম এবং সার্ভার, ক্যাশিং সার্ভিস, বিভিন্ন প্লাগিন ইত্যাদি বিদেশ থেকে ডলারের মাধ্যমেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্রয় করা হয়। দেশে রিজার্ভ কমে গেলে ডলার সংকট দেখা দিবে। আর এসব পণ্য বা সেবা খয় করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।

উপসংহার

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। রেমিট্যান্স না আসলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে সামাজিক ও পারিবারিক স্থিতিশীলতা, সবকিছুতেই রেমিট্যান্সের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর সমস্যাও দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারে। তাই, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়াটি সহজ ও নিরাপদ করা এবং অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য প্রবাসীদের অবদান এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top