মধ্যযুগে শুরু হওয়া ব্যাংক ব্যবস্থার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলো অর্থের সংরক্ষন ও আমানত গ্রহন। পরবর্তীতে যতই সময় গিয়েছে ব্যাংক ব্যবহার এবং ব্যাংকের উপকারিতার পাশাপাশি ব্যাংকিং সিস্টেম জনপ্রিয় হয়েছে। ততকালীন রোম সভ্যতায় ব্যবসায়ী ও মহাজনগণের সম্মিলিত উদ্যোগে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে। এবং তারপর থেকেই ব্যাংক লোন নামক টার্মটি সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তা অর্জন।
সেই থেকে এখন অব্দি মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যাংক লোন গ্রহন করছে। কালের বিবর্তনে ও ভৌগলিক অবস্থানগত কারনে ব্যাংক লোন গ্রহনের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে এখানে আমি বিস্তারিত বলার চেষ্টা করবো কিভাবে খুব সহজে ব্যাংক লোন পেতে পারেন বা ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায় সম্পর্কে। তাহলে শুরু করা যাক মূল আলোচনা।
ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায়
উপরে ব্যাংক সম্পর্কে কিছু ধারণার পাশাপাশি ব্যাংক লোনের সৃষ্টি সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়েছি। তবে ব্যাংক লোন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখনও প্রদান করা হয়নি।
আপনি কোনো কিছু গ্রহণ করার আগে অবশ্যই সে জিনিস সম্পর্কে সচ্ছ ধারণা রাখা বা জানতে ইচ্ছুক। সেকারণে ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায় সম্পর্কে জানানোর আগে ব্যাংক লোন সংক্রান্ত ব্যাসিক কিছু তথ্য জেনে নিন।
ব্যাংক লোন কি? ব্যাংক লোনের ধরণ ও প্রকারভেদ
খুব সহজ করে বললে, আর্থিক চাহিদা পুরণের জন্য একটা নিদিষ্ট সময়ের জন্য ব্যাংক হতে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থের যোগান দেয়াই হলো ব্যাংক লোন। লোন বা Loan শব্দটি ইংরেজি শব্দ, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে “ ধার, কর্য, ঋন “। যেহেতু ব্যাংক ইংরেজি শব্দ তাই শ্রুতিমধুরতা বজায় রাখতে লোন শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ব্যাংক লোন কত প্রকার ও কি কি?
সাধারণত ব্যাংক ৩ ধরনের লোন ব্যবস্থা চালু রেখেছে যা হচ্ছে,
- (১) সল্পমেয়াদি ব্যাংক লোন,
- (২) মধ্যমেয়াদি ব্যাংক লোন ও
- (৩) দীর্ঘমেয়াদি ব্যাংক লোন।
সল্পমেয়াদি ব্যাংক লোন এর ক্ষেত্রে গ্রাহক ব্যাংক হতে নিদ্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ গ্রহণ করতে পারবে, যার শর্ত থাকবে এই যে, তাকে অবশ্যই ১ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। যার মানে এই যে, সল্পমেয়াদি ব্যাংক লোনের মেয়াদ ১ বছরের কম বা ১ বছরের সমান হয়ে থাকে।
আরো পড়ুনঃ ডাচ বাংলা ব্যাংক লোন সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য
যখন আপনাকে ১ বছর থেকে বেশি মেয়াদি ঋন দেয়া হবে, মানে এক বছরের চেয়ে বেশি সময় ও সর্বোচ্চ ৫ বছর অব্দি ঋন পরিশোধের ব্যবস্থা থাকবে সেটিকে মধ্যমেয়াদি ব্যাংক লোন বলা হবে।
আর সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘ সময় ধরে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থাকে বলা হয় দীর্ঘ মেয়াদি ব্যাংক লোন। যেখানে আপনাকে সর্বোচ্চ সময় দেয়া হবে ঋণ পরিশোধ করার জন্য। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ৫ থেকে ১০ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০ বছর অব্দি ঋণ পরিশোধের সুযোগ থাকে।
ব্যাংক লোনের অন্যান্য ক্ষেত্র সমূহ
- কার লোন – কোনো গাড়ি বা অটোমোবাইক নেয়ার জন্য এই ঋণ নেয়া যায়।
- হোম লোন – যেকোনো প্রোপার্টি, এপার্টমেন্ট কেনা বা বাড়ি বানানোর জন্য এই লোন দেয়া হয়।
- পার্সোনাল লোন – ব্যাক্তিগত যেকোনো কারণে বা পরিবারের জন্য এই ধরণের লোন দেয়া হয়।
- এডুকেশন লোন – শিক্ষা গ্রহণের উদ্দ্যেশে দেয়া লোনকে এডুকেশন লোন বলে।
- ব্যবসা লোন – কোনো ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে যে লোন গ্রহণ করা হয় তাই বিজনেস লোন।
- প্রবাসী লোন – দেশের বাইরে যাওয়ার উদ্দ্যেশে যে ঋণ গ্রহণ করা হয় তাই প্রবাসী লোন।
- কৃষি লোন – কৃষি কাজ সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাংক যেই ঋণ প্রদান করে তাই কৃষি লোন।
সহজে ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায় ও করনীয়
এবার আপনি ব্যাংক লোন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাংক লোন দিয়ে থাকে সেসব সম্পর্কে জানেন। এবার জানবেন ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায় সম্পর্কে এবং কোন কোন বিষয় আয়ত্বে রাখলে সহজেই কোনো ঝামেলা ছাড়াই ব্যাংক লোন গ্রহন করতে পারবেন।
ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায় গুলো
আপনার প্রয়োজন নির্ধারণ করুন – উপরের অংশে অবশ্যই খেয়াল করেছেন যে বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুযায়ী ব্যাংক লোন প্রদান করে থাকে। তাই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই প্রয়োজন বুঝতে হবে।
বাড়ি বানানোর জন্য যেমন সল্পমেয়াদী লোন নিয়ে কাজ হবে না তেমনই কৃষিকাজের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী ঋনের প্রয়োজন নেই। চাহিদা মোতাবেক দেখুন আপনার কি প্রয়োজনের ও কি পরিমাণের ঋন প্রয়োজন।
আরো পড়ুনঃ ৭ দিনে ইসলামী ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার পদ্ধতি
যে ব্যাংক থেকে লোন গ্রহণ করবেন তা নির্ধারন করুন – বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মোট ব্যাংক সংখ্যা ৬৭ টি। সব ব্যাংকে যেমন আপনার সুবিধা মোতাবেক ঋন ব্যবস্থা নেই তেমনই সকল ব্যাংক আপনাকে ঋন প্রদান করবে না। তার জন্য প্রয়োজন বাছাই করুন যে, কোন ব্যাংক থেকে আপনার ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করা উচিৎ।
নিম্মে দেয়া সেরা কিছু ব্যাংক, যেগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করতে পারেন যে, কোন ব্যাংক থেকে আপনি ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করবেন।
ব্যাংক লোনের জন্য সেরা কিছু ব্যাংক
- এবি ব্যাংক
- ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড
- সোনালী ব্যাংক
- ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড
- জনতা ব্যাংক
- ব্র্যাক ব্যাংক
- স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক
- প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড
- ব্যাংক এশিয়া
- সিটি ব্যাংক
কোন ব্যাংক বেছে নিবেন?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় সব ধরণের ব্যাংক ঋণ প্রদান করে থাকে। তবে এর মধ্যেই আপনাকে বুঝে নিতে হবে কোন ব্যাংকে আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো।
ব্যাংক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে লোনের সুদের হার। আপনাকে দেখতে হবে কোন ব্যাংক কত সুদের হারে আপনাকে লোন দিতে ইচ্ছুক হচ্ছে। যেই ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট সবচেয়ে কম সেই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ বেশি সুবিধাজনক।
আরো পড়ুনঃ অগ্রণী ব্যাংক লোন সিস্টেম | Agrani Bank Loan
সুদের হার সম্পর্কে ধারণা
বাংলাদেশে ‘ব্যাংক ঋণ আইন‘ অনুযায়ী একটি ব্যাংক গ্রহীতার ঋণের উপর সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ ধার্য করতে পারবেন। প্রতিযোগিতার খাতিরে চাইলে একটি ব্যাংক ৯ শতাংশ এর কম সুদের হারে ঋণ ধার্য করতে পারে। সেই সুবাদে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ ব্যাংক থেকেই ৭-৮ শতাংশ হারে ঋণ দিতে দেখা যায়।
তবে কোনো ক্ষেত্রেই ৯% এর বেশি সুদের হার ধার্য করতে পারবে না, যদি কিনা সে ঋণ খেলাফি করে থাকে। কারণ ঋন খেলাফি করলে ২% অতিরিক্ত চার্জ ধার্য করার ক্ষমতা ব্যাংক রাখে। উল্লেখ্য যে, ব্যাংক সুদের হার কত রাখবে তা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে থাকে।
ইন্সটলমেন্টের আকার কত তা জেনে নিন – ইনস্টলমেন্ট হলো মাসে আপনি কত টাকা ব্যাংকে প্রদান করবেন ঋণ গ্রহণের পর তার হিসাব। EMI এর উপর নির্ভর করে লোনের পরিমাণ ও সেই লোনের উপর সুদের হার নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে অনলাইন ইএমআই কত সেটা নির্ণয় করা যায় কেবলমাত্র ঋণের পরিমাণ ও সুদের হার প্রদান করার মাধ্যমে। EMI চেক করতে এখানে ক্লিক করুন।
ব্যাংক লোন পাওয়ার শর্ত সমূহ
যে কোন ব্যাংক থেকে লোন পাওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, আপনাকে অবশ্যই ব্যাংকের নিয়ম মেনে ঋণ গ্রহণ করতে হবে। ঋণ গ্রহণের পর যথাসময়ে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ঋণ গ্রহণের সময় যে সকল ডকুমেন্টস দেখানো প্রয়োজন হয় সেগুলো উপস্থাপন করতে হবে। কোনভাবেই কোন প্রকার অনৈতিক স্টেটমেন্ট এর প্রমাণ পত্র প্রদান করা যাবে না। ব্যাংক লোন পাওয়ার জন্য কি কি কাগজপত্র প্রয়োজন সে সম্পর্কে নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
ব্যাংক লোন পেতে কি কি কাগজপত্রের প্রয়োজন?
- ব্যাংক কর্তৃক প্রদানকৃত আবেদন ফরম টি যথাযথভাবে পূরণ করতে হবে এবং সেখানে উল্লেখযোগ্য স্থানে স্বাক্ষর করতে হবে।
- আবেদনকারীর সদ্যতোলা দুই বা একাধিক পাসপোর্ট সাইজের রঙ্গিন ছবি প্রয়োজন হবে।
- আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয় পত্র, অফিস আইডি, ভিজিটিং কার্ড, অন্যান্য ডকুমেন্ট এর ফটোকপি প্রদান করতে হবে।
- মোবাইল নাম্বার, গ্যাস অথবা বিদ্যুৎ বিলের ফটোকপি জমা দিতে হবে।
- যদি TIN নাম্বার থেকে থাকে তাহলে তা দিতে হবে।
- ন্যূনতম ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখাতে হবে।
- অন্যান্য আইন প্রুভ ডকুমেন্টস দেখাতে হবে।
- ট্রেড লাইসেন্স, অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের স্মরকলিপি, ভাড়া চুক্তি বা মালিকানার দলিল সহ অন্যান্য ভাড়া ও পরিদর্শন প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে হবে।
- এছাড়াও ব্যাংকের চাহিদা ও প্রয়োজনের সুবাদে যদি কোন ডকুমেন্টস দেখতে চাওয়া হয় তাহলে অবশ্যই তা উপস্থাপন করতে হবে।
আরো পড়ুনঃ সিটি ব্যাংক লোন নিয়ে বিস্তারিত | City Bank Loan System
জামানত হিসেবে কি দেয়া লাগে?
ব্যাংক আপনাকে নগদ অর্থ ঋণ হিসাবে প্রদান করবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের নিরাপত্তার সুবাদে ব্যাংক আপনার কাছ থেকে বিক্রয়যোগ্য অথবা নগদায়নযোগ্য, বৈধ যে সকল সম্পদ ব্যাংকের কাছে রাখে সেটাই জামানত হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এটি হতে পারে জমি, বাড়ি, ফ্লাট, গয়না, দালানকোঠা, গাড়ি এবং অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি সমূহ।
ঋণগ্রহীতা যদি কোনো কারণে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হয়ে থাকে তাহলে ব্যাংক কর্তীপক্ষ বন্ধকী জামানত বিক্রি করার মাধ্যমে সেই পাওনা পরিশোধ করে নেয়।
তবে বর্তমানে এমন অনেক ব্যাংক রয়েছে যেগুলো কোনো শর্ত ছাড়া বা সহজশর্তে লোন দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে কোন জামানত দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যেমন বিকাশ থেকে লোন গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনাকে কোন প্রকার জামানত দিতে হচ্ছে না।
আরো পড়ুনঃ কর্মসংস্থান ব্যাংক লোন পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য
শেষ কথা
পরিশেষে বলতে হয়, ব্যাংক লোন গ্রহণের ক্ষেত্রে উপরে উল্লেখিত বিষয় গুলো সরণে রেখে কার্যক্রম সম্পাদন করলে খুব সহজেই যেকোনো ব্যাংক থেকে ঋন বা লোন গ্রহন করতে পারবেন। আশা করি ব্যাংক লোন পাওয়ার উপায় গুলো জেনে আপনার কিছুটা হলেও উপকার হয়েছে। ব্যাংক সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য জানতে অবশ্যই আমাদের ওয়েবসাইটি ভিজিট করবেন। ধন্যবাদ।