মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি কি? মূল্যস্ফীতি কেন হয়?

মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি আলাদা জিনিস হলেও একটির সাথে আরেকটির সম্পর্ক খুবই বেশি। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানানোর চেষ্টা করব মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি কি, মূল্যস্ফীতি কেন হয়, এর প্রভাব, বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি। চলুন কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।

মূল্যস্ফীতি কি?

মূল্যস্ফীতি হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া, অর্থাৎ আগের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে এখন একই পণ্য বা সেবা কিনতে হচ্ছে। বাজারে যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায় কিন্তু পণ্য বা সেবার পরিমাণ একই থাকে তখনই মূল্যস্ফীতি হয়। আর এই মুদ্রাস্ফীতির ফলেই মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে।

মুদ্রাস্ফীতি কি?

মুদ্রাস্ফীতি বলতে বোঝায় পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়াকে। যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে। সহজ ভাষায় বললে, একটি দেশের বাজারে পণ্যের মজুদ এবং মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। মুদ্রাস্ফীতি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।

মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে পার্থক্য

মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে অর্থনীতিতে মুদ্রার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। মূল্যস্ফীতি হচ্ছে কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া। ব্যাপারটা হচ্ছে অর্থনীতিতে যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায় কিন্তু পণ্য বা সেবার পরিমাণ একই থাকে তখনই মূল্যস্ফীতি হয়। অর্থাৎ বেশি টাকা দিয়ে কম পণ্য বা সেবা কিনতে হয়।

মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি
মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি

মূল্যস্ফীতি কেন হয়?

বিভিন্ন কারণে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। বাজারে যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায় কিন্তু পণ্য বা সেবার পরিমাণ একই থাকে তখনই মূল্যস্ফীতি হয়। এটি মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। মূল্যস্ফীতির অন্যান্য কিছু কারণ হলোঃ

  • জ্বালানি এবং খাদ্যের দাম বৃদ্ধি
  • শ্রম খরচ বৃদ্ধি
  • সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি
  • মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি
  • আমদানি বৃদ্ধি
  • ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন
  • কৃষি পণ্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন না হওয়া
  • চাহিদা ব্যাপক থাকা সত্বেও কিছু পণ্যের ব্যাপক রপ্তানি
  • দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি
  • বিশ্ব বাজারে জ্বালানী পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি

উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন একটি কাজ। নিচে এই বিষয়ে আলোচনা করা হলো।

মূল্যস্ফীতির প্রভাব

যেকোন দেশে মূল্যস্ফীতির প্রভাব খুব ব্যাপক। মূল্যস্ফীতি হলে খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, বাড়িভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে যায়। মানুষকে এসব সেবা বা পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। আয়ের পরিবর্তন না হলে তখন মানুষ এগুলো প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনতে বাধ্য হন। তাদের সঞ্চয় কমে যায় এবং অন্যান্য খাতের খরচ কমিয়ে ফেলতে হয়। মূল্যস্ফীতির ফলে আরো নানা রকম সমস্যার দেখা দেয়। সেগুলো হলোঃ

  • ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস
  • জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি
  • বিনিয়োগের ক্ষতি
  • অর্থনৈতিক মন্দা
  • রাজনৈতিক অস্থিরতা

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায়

  • মুদ্রাস্ফীতি দূর করতে হলে অর্থের পরিমাণ কমাতে হবে। অর্থের পরিমাণ কমলে পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে এবং দামও কমে।
  • অর্থের পরিমাণ কমাতে হলে ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণও কমাতে হবে। ব্যাংক ঋণ দেয় বলে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তাই ব্যাংক ঋণ কম দিলে অর্থের পরিমাণ কমে।
  • ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণ কমাতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক হার বৃদ্ধি করে, যাতে ব্যাংক ঋণ দেওয়া কমিয়ে দেয়।
  • কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে সরকারি ঋণপত্র বিক্রয় করে। এতে ব্যাংকের কাছে অর্থ কমে যায় এবং তারা ঋণ দেওয়া কমিয়ে দেয়।
  • কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের রিজার্ভের হার পরিবর্তন করে। এতে ব্যাংকের কাছে অর্থ কমে যায় এবং তারা ঋণ দেওয়া কমিয়ে দেয়।
  • কেন্দ্রীয় ব্যাংক নৈতিক চাপ প্রয়োগ করে। এতে ব্যাংকগুলিকে ঋণ দেওয়া কমিয়ে দিতে বলে।
  • কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রত্যক্ষ ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই ব্যাংকগুলিকে ঋণ দেয়, যাতে তারা অন্যদের ঋণ দিতে কম ঋণ পায়।
  • মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে এখন থেকেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই মুদ্রাস্ফীতি হওয়ার আগেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকের ভূমিকা

সাধারণত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূল্যস্ফীতি রোধে এবং মূল্য স্থিতিশীলতা রক্ষায় সুদের হার বাড়িয়ে থাকে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) মতে, উচ্চ সুদ হার বজায় থাকলে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে ঋণের চাহিদা কমে যায়। এতে ব্যয় ও বিনিয়োগ দুটোই কমে। এটি অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ কমায়।1

মূল্যস্ফীতি কিভাবে পরিমাপ করা হয়?

মূল্যস্ফীতি মাপার জন্য দুটি প্রধান ইন্ডেক্স ব্যবহৃত হয় – হোলসেল প্রাইস ইনডেক্স (Wholesale Price Index, WPI) এবং কনসিউমার প্রাইস ইনডেক্স (Consumer Price Index, CPI)।

  1. হোলসেল প্রাইস ইনডেক্স (WPI): WPI হল মূল্যের স্থানীয় ও ব্যবসায়িক স্তরের মূল্য পরিবর্তনের পরিমাপের একটি ইন্ডেক্স। এটি সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়িক উৎপাদনের মৌলিক উপাদানের মূল্য পরিবর্তন নির্ধারণ করে।
  2. কনসিউমার প্রাইস ইনডেক্স (CPI): CPI হল মূল্যের সাধারণ জনগণের জন্য স্থানীয় ও মৌলিক পরিবর্তনের পরিমাপের একটি ইন্ডেক্স। এটি একজন সাধারণ জনগণের দৈনিক জীবনযাত্রার ব্যয় পরিবর্তন নির্ধারণ করে।

মূল্যস্ফীতির প্রভাব থেকে কীভাবে রক্ষা করা যায়?

মূল্যস্ফীতির প্রভাব ব্যাপক। এর থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা পাওয়া খুবই কঠিন, অসম্ভবও বলা যেতে পারে। তবে কিছু পদক্ষেপ নিলে মূল্যস্ফীতির প্রভাব কিছুটা কমানো সম্ভব। সেগুলো হলোঃ

  • সঠিকভাবে বিনিয়োগ
  • আয় বাড়ানো
  • সঞ্চয় বৃদ্ধি
  • স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ
  • অপ্রয়োনীয় খরচ কমানো
  • আলাদাভাবে ইমার্জেন্সি সেভিংস করা যা আপনি জরুরী প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবেন

বর্তমানে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কত?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রভিশনাল হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার এপ্রিল, ২০২৩ পর্যন্ত ৮ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল।2

শেষ কথা

মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি খুবই জটিল একটি টপিক। আমরা যতটা সম্ভব সহজভাবে এটিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। আশা করছি এই বিষয়ে আপনাদের কিছুটা হলেও ধারণা হয়েছে। এতক্ষণ সময় নিয়ে পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

  1. https://bangla.thedailystar.net/economy/news-399156 ↩︎
  2. https://bangla.thedailystar.net/business/news-483796 ↩︎

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *