লোন নেওয়ার আগে কোন কোন বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই জেনে নিতে হবে — বিস্তারিত গাইড ২০২৫

বর্তমান সময়ে আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য লোন নেওয়া অনেক সাধারণ ঘটনা। হোক তা পার্সোনাল লোন, হাউজিং লোন, বা ব্যবসায়িক ঋণ — সঠিক পরিকল্পনা ও তথ্য ছাড়া লোন নেওয়া ভবিষ্যতে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। অনেকে আবার সুদের হার বা চার্জ না জেনে লোন নিয়ে মাস শেষে কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই আজকের এই আর্টিকেলে জানাবো লোন নেওয়ার আগে কোন কোন বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই জেনে নিতে হবে। যারা নতুন লোন নেওয়ার কথা ভাবছেন, তাদের জন্য এই তথ্যগুলো বিশেষ উপকারে আসবে।

লোন নেওয়ার আগে কোন কোন বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই জেনে নিতে হবে
Bank Loan (ব্যাংক লোন)

লোনের ধরন ও উপযোগিতা বুঝুন

প্রথমেই বুঝতে হবে, আপনি কোন প্রয়োজনে লোন নিতে যাচ্ছেন। কারণ প্রত্যেক লোনের উদ্দেশ্য আলাদা এবং শর্তও ভিন্ন। যেমন:

  • পার্সোনাল লোন: ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য।
  • হাউজিং লোন: জমি বা ফ্ল্যাট কেনা বা নির্মাণের জন্য।
  • কার লোন: গাড়ি কেনার জন্য।
  • এডুকেশন লোন: পড়াশোনার খরচ মেটানোর জন্য।
  • ব্যবসায়িক লোন: ব্যবসা শুরু বা সম্প্রসারণের জন্য।

প্রতিটি লোনের সুদের হার, মেয়াদ এবং শর্ত আলাদা। তাই প্রয়োজন বুঝে সঠিক লোন সিলেক্ট করাটাই প্রথম ধাপ।

সুদের হার (Interest Rate) যাচাই করুন

লোন নেওয়ার সময় সুদের হার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুদের হার বেশি হলে মাসিক কিস্তি ও লোন পরিশোধের চাপ অনেক বেড়ে যাবে।

সুদের হার দুই ধরনের হতে পারে:

  • ফিক্সড ইন্টারেস্ট রেট — পুরো মেয়াদে একই সুদ।
  • ভ্যারিয়েবল ইন্টারেস্ট রেট — সময়ের সাথে বাড়তে বা কমতে পারে।

ব্যাংক, এনবিএফআই ও অ্যাপ-ভিত্তিক লোন প্রতিষ্ঠানের সুদের হার আগে যাচাই করা উচিত। প্রয়োজনে একাধিক প্রতিষ্ঠানের রেট তুলনা করুন।

প্রসেসিং ফি, ডকুমেন্টেশন ও লুকানো চার্জ

অনেকে শুধু সুদের হার দেখে লোন নেন, অথচ লোনের সঙ্গে থাকা প্রসেসিং ফি, ডকুমেন্ট চার্জ, প্রি-পেমেন্ট পেনাল্টি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ।

লোন নেওয়ার আগে দেখে নিন:

  • প্রসেসিং ফি কত? (% বা নির্ধারিত টাকা)
  • ডকুমেন্টেশন চার্জ আছে কিনা
  • কিস্তি মিস করলে জরিমানা কত
  • আগেভাগে পরিশোধ করলে চার্জ কত

এই লুকানো চার্জ জানাটা জরুরি, নাহলে শেষে গিয়ে অতিরিক্ত খরচে পড়তে হবে।

মাসিক কিস্তি (EMI) ক্যালকুলেট করে নিন

অনেকেই না জেনে বেশি অংকের লোন নিয়ে মাস শেষে কিস্তির টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খান। তাই আগেভাগে মাসিক EMI (Equated Monthly Installment) হিসাব করে নিন।

লোন অ্যামাউন্ট, সুদের হার ও মেয়াদ অনুযায়ী EMI হিসাব করে নিজের আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখুন। সাধারণত:

মাসিক আয়ের ৩০%-৪০% এর বেশি EMI হলে তা আর্থিক ঝুঁকিপূর্ণ।

ব্যাংকের ওয়েবসাইটে থাকা EMI ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারেন।

লোনের মেয়াদ ঠিক করুন

লোনের মেয়াদ বেশি হলে EMI কম হবে, তবে মোট সুদের পরিমাণ বেড়ে যাবে। আবার মেয়াদ কম হলে EMI বেশি হলেও মোট সুদ কম লাগবে।

তাই নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী লোনের মেয়াদ ঠিক করুন। ভবিষ্যতে আয় বাড়বে কিনা বা কোনো অতিরিক্ত আয় হবে কিনা — সেসব ভেবে মেয়াদ বাছাই করাই ভালো।

কাগজপত্র ও শর্তাবলী ভালোভাবে পড়ুন

লোন নেওয়ার সময় ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানির দেওয়া চুক্তিপত্র (Loan Agreement) সময় নিয়ে পড়ুন।

চুক্তিপত্রে যা থাকে:

  • সুদের হার
  • EMI
  • মেয়াদ
  • চার্জ
  • জরিমানা শর্ত
  • জামিনদার বা বন্ধক সংক্রান্ত নিয়ম

সব পড়েই সাইন করুন। ভুলে বা না বুঝে সই করলে পরে বিপদে পড়তে পারেন।

প্রি-পেমেন্ট ও আর্লি সেটেলমেন্ট সুবিধা

অনেক সময় হাতে বাড়তি টাকা এলে আগেভাগে লোন পরিশোধ করতে চাইলে অনেক প্রতিষ্ঠান চার্জ নেয়। আবার কেউ কেউ রিবেটও দেয়।

তাই আগেই জেনে নিন:

  • প্রি-পেমেন্ট চার্জ আছে কিনা
  • কত % চার্জ নেয়
  • সুদের রিবেট দেয়া হয় কিনা

এই সুবিধা থাকলে লোন আগে পরিশোধ করে আর্থিক চাপ কমাতে পারবেন।

ক্রেডিট রিপোর্ট ও যোগ্যতা যাচাই

ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলো লোন দেওয়ার আগে আপনার ক্রেডিট রিপোর্ট (CBR) দেখে। পূর্বে কোনো লোন অনিয়ম থাকলে বা ক্রেডিট কার্ডের বিল বাকি থাকলে লোন বাতিলও হতে পারে।

আপনি নিজেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে CBR চেক করতে পারবেন। প্রয়োজনে আগে সে সমস্যা মিটিয়ে নিন।

জামিনদার বা বন্ধক প্রয়োজন হবে কিনা

বেশিরভাগ পার্সোনাল লোন জামিনদার ছাড়া পাওয়া যায়। তবে হাউজিং, বড় অংকের ব্যবসায়িক লোনের ক্ষেত্রে জামিনদার বা বন্ধক (Collateral) প্রয়োজন হয়।

তাই লোন নেওয়ার আগে জানতে হবে:

  • জামিনদার লাগবে কিনা
  • কি ধরনের বন্ধক জমা দিতে হবে
  • বন্ধকের মূল্যের তুলনা

প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমাণ নির্ধারণ

অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লোন নিয়ে অযথা সুদের চাপ বাড়ান। আবার কম নিয়ে সমস্যায় পড়েন।

তাই সঠিক বাজেট করে প্রয়োজন বুঝে যতটুকু দরকার, ততটুকু লোন নিন। এতে সুদের চাপ ও EMI manageable থাকবে।

ইসলামী ব্যাংকিং বা শরিয়া ভিত্তিক লোন অপশন আছে কিনা

যারা ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী ব্যাংকিং করতে চান, তারা চাইলে ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেমের হালাল লোন (মুরাবাহা, মুশারাকা, ইজারা) নিতে পারেন।

এক্ষেত্রে সুদ না নিয়ে লাভের ভিত্তিতে মাসিক কিস্তি নির্ধারণ হয়। আগ্রহী হলে প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের ইসলামিক উইংয়ে যোগাযোগ করুন।

লোন ইন্স্যুরেন্স সুবিধা

অনেক ব্যাংক লোনের সাথে লাইফ ইন্স্যুরেন্স সুবিধা দেয়। এতে গ্রাহকের অকাল মৃত্যু হলে ইন্স্যুরেন্স থেকে লোন পরিশোধ হয়ে যায়।

তাই লোন নেওয়ার আগে এই সুবিধা আছে কিনা দেখে নিন। প্রয়োজনে এই সুবিধা নিতে পারেন।

শেষ কথা

লোন নেওয়ার আগে ভালোভাবে সবদিক বিবেচনা করে, লোনের ধরন, সুদের হার, EMI, চার্জ, মেয়াদ, শর্তাবলী, জামিনদার, প্রি-পেমেন্ট সুবিধা — এগুলো খতিয়ে দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নিন।

ভেবে-চিন্তে লোন নেওয়া আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। আর প্রয়োজনে লোন বিশেষজ্ঞ পরামর্শও নিতে পারেন। মনে রাখুন, দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত আপনার ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তার প্রথম ধাপ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top